আহলে বাইত (আ.) বার্তা সংস্থা (আবনা): ফিলিস্তিনি সিভিল ডিফেন্সের তথ্য অনুযায়ী, গত কয়েক সপ্তাহে অন্তত ৫০টি বহুতল ভবন ধ্বংস করা হয়েছে। জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতির মধ্যেই এসব ধ্বংসযজ্ঞ চলছে।
গাজার আশেপাশের শহরগুলোর অবস্থা ভয়াবহ। আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এর মধ্যে জায়তুন শহরের প্রায় পুরোটাই নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে। আগস্টের শুরু থেকে এখানে ১৫০০টির বেশি ঘরবাড়ি ও স্থাপনা ধ্বংস করা হয়েছে। এখানে বেশিরভাগ অংশেই আর কোনো ভবন অবশিষ্ট নেই।
জোর করে দক্ষিণে ঠেলে দিচ্ছে ইসরায়েলি বাহিনী
গত ২৩ আগস্ট ইসরায়েলের পূর্ণাঙ্গ সামরিক হামলার আগে স্যাটেলাইট ইমেজে গাজা সিটির কাছে আল-শাতি ক্যাম্প। ডানের ছবিতে ৯ সেপ্টেম্বরের চিত্র। ছবি: রয়টার্স
দক্ষিণমুখী দুইটি প্রধান সড়কই কার্যত বন্ধ—সালাহ আল-দিন রোড স্নাইপারদের দখলে, আর উপকূলীয় আল-রশিদ রোডে বাস্তুচ্যুত পরিবারগুলোর তাঁবু বসায় যান চলাচল অচল। এমনকি ইসরায়েলের ঘোষিত "মানবিক অঞ্চল" আল-মাওয়াসিতেও নিরাপত্তা নেই।
সেপ্টেম্বর মাসের স্যাটেলাইট ছবিতে দেখা যায় ইসরায়েলি হামলায় গাজার উত্তরাঞ্চলের বহু এলাকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে এবং অনেক হাসপাতাল, স্কুল, মসজিদ ও বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বা পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে।
গাজার উত্তরাঞ্চলের নয়টি এলাকায় হামলার আগের ও পরের চিত্র স্যাটেলাইট ইমেজে উঠে এসেছে। বিস্তারিত প্রকাশ করেছে আল জাজিরা।
শেখ রাদওয়ান
গত কয়েক সপ্তাহ ধরে গাজা সিটির শেখ রাদওয়ানে টানা ও তীব্র ইসরায়েলি হামলা চালানো হয়। ঘনবসতিপূর্ণ এই এলাকাটি জনাকীর্ণ বাজার এবং সরু রাস্তার জন্য পরিচিত।
আশ্রয় নেওয়া মানুষদের চোখের সামনে ট্যাংক ঢুকে বাড়িঘর ও তাঁবু গুঁড়িয়ে দিয়েছে।
রেমাল
গাজার উত্তরে এবং দক্ষিণের রেমাল এলাকায় আল-শিফা হাসপাতালের মতো বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা আছে। আল-শিফা গাজার সবচেয়ে বড় হাসপাতাল। শহরের প্রধান সমুদ্রবন্দরটিও এখানেই।
হাসপাতালটির আশেপাশে বেশ কয়েকটি জাতিসংঘের কার্যালয় ছিল। এর মধ্যে ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের জন্য জাতিসংঘের সংস্থা (ইউএনআরডব্লিউএ), মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রক্রিয়ার জন্য জাতিসংঘের বিশেষ সমন্বয়কারীর কার্যালয় (ইউনেসকো) এবং জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি)।
রেমাল গাজার শিক্ষাব্যবস্থারও অন্যতম প্রাণকেন্দ্র। এখানে ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব গাজা, আল-আজহার ইউনিভার্সিটি এবং আল-আকসা ইউনিভার্সিটির মতো প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মাত্র কয়েকশ মিটার দূরত্বে অবস্থিত ছিল।
গত কয়েক সপ্তাহে ইসরায়েলের হামলায় রেমালের বেশ কয়েকটি বহুতল আবাসিক ও অফিস ভবন ধ্বংস হয়ে গেছে। এর মধ্যে আছে মুস্তাহা টাওয়ার, আল-রুয়া ভবন, আল-সালাম টাওয়ার, তিবা টাওয়ার এবং অন্যান্য বহুতল ভবন।
তুফাহ
ইসরায়েলি বাহিনী তুফাহতে আবাসিক এলাকা এবং অবকাঠামো লক্ষ্য করে একাধিক বিমান হামলা ও স্থল অভিযান চালিয়েছে।
একসময়কার প্রাণবন্ত এই এলাকাটি জমজমাট বাজার, স্কুল এবং কমিউনিটি স্পেসের জন্য পরিচিত ছিল। কিন্তু স্যাটেলাইট চিত্র থেকে দেখা যায়, এলাকাটির পুরো অংশ এখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
সাবরা
ফিলিস্তিনি সিভিল ডিফেন্স আগস্ট মাসে জানায়, গত ৬ আগস্ট থেকে ইসরায়েল গাজা সিটিতে ক্রমাগত হামলা শুরু করার পর থেকে এর পার্শ্ববর্তী জায়তুন এবং সাবরা এলাকায় ১ হাজারেরও বেশি ভবন ধ্বংস করেছে। এতে শত শত মানুষ ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে।
জায়তুন
গাজা শহরের অন্যতম বড় এলাকা জায়তুন একসময় তার ব্যস্ত বাজার, জলপাই বাগান এবং স্থানীয়ের মধ্যে সম্প্রীতির জন্য পরিচিত ছিল।
সেই জায়তুন আজ আর নেই। পুরো এলাকা ধ্বংসস্তূপে পরণিত হয়েছে। বাড়িঘরগুলো ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়ায় এখানকার বাসিন্দারা এখন বাস্তুচ্যুত।
শুজাইয়া
আরবিতে শুজাইয়া অর্থ 'সাহস'। গাজা সিটির পূর্ব দিকে ইসরায়েল সীমান্তের কাছে অবস্থিত শুজাইয়া।
ঐতিহাসিকভাবে এটি বাজার, স্কুল এবং কমিউনিটি সেন্টার নিয়ে গঠিত একটি আবাসিক ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র। এটি গাজার অন্যতম বৃহত্তম এবং সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা।
গাজা সিটির পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত হওয়ায় সামরিক অভিযানের সময় এই এলাকাটি বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। কারণ এটি ইসরায়েলের খুব কাছে অবস্থিত।
বেইত লাহিয়া
গাজা সিটির উত্তরে, উত্তর গাজা গভর্নরেটে অবস্থিত বেইত লাহিয়া একসময় এর রসালো স্ট্রবেরির জন্য পরিচিত ছিল। যাকে স্থানীয়ভাবে 'রেড গোল্ড' বলা হতো।
ইসরায়েলি বুলডোজার এবং ভারী যন্ত্রপাতি এই খেতগুলোকে ধ্বংস করে পুরোপুরি মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে।
গাজার উত্তরাঞ্চলের বেশিরভাগ অংশের মতো, বেইত লাহিয়ার মানবিক পরিস্থিতিও ভয়াবহ।
দুর্ভিক্ষ পর্যবেক্ষণ সংস্থা ইনটিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্লাসিফিকেশন (আইপিসি) আগস্ট মাসে উত্তর গাজায় দুর্ভিক্ষ ঘোষণা করে। তাদের মতে উত্তর গাজায় দুর্ভিক্ষ ঘোষণা করে, যেখানে শত শত হাজার মানুষ ক্ষুধা ও বাস্তুচ্যুতির শিকার। আইপিসি আরও জানায় যে, সেপ্টেম্বরের শেষে এই সংকট গাজার মধ্য ও দক্ষিণাঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়তে পারে।
বেইত হানুন
সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বেইত হানুন ইসরায়েলের চলমান হামলায় সবচেয়ে বিধ্বস্ত এলাকাগুলোর মধ্যে একটি। এটি বেইত লাহিয়ার দক্ষিণে এবং গাজা সিটির উত্তরে অবস্থিত।
ইসরায়েলের সাথে বেইত হানুন ক্রসিং (যা ইসরায়েলে এরেজ ক্রসিং নামে পরিচিত) বন্ধ করে দেওয়ায় মানবিক সংকট আরও ভয়াবহ হয়েছে। এর ফলে সাহায্য সামগ্রী পৌঁছানো এবং মানুষের চলাচল সীমিত হয়ে পড়েছে।
জাবালিয়া
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী বারবার জাবালিয়া এলাকায় হামলা চালিয়েছে, যার মধ্যে গাজার বৃহত্তম শরণার্থী শিবির জাবালিয়া ক্যাম্পও রয়েছে।
১৯৪৮ সালে ইসরায়েল গঠনের সময় বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিদের জন্য এই ক্যাম্পটি তৈরি করা হয়েছিল। এই ক্যাম্পটি অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ।
একসময় এই ক্যাম্পে জাতিসংঘের অধীনে তিনটি স্কুল ছিল, যা শত শত বাস্তুচ্যুত পরিবারের জন্য আশ্রয়কেন্দ্রে রূপান্তরিত হয়েছিল।
Your Comment